নোবেল পুরস্কার যাদের প্রাপ্য!

প্রকাশিত: ৭:০৮ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৫, ২০১৮

এই শহরের এক জায়গায় বিনামূল্যে খাবার খাওয়ানো হচ্ছে। সেটা একদিন দুইদিনের ঘটনা না, চুরানব্বই বছর ধরে চলছে এই বিনামূল্যে খাবার খাওয়ানোর কাজ। মদনমোহন পাল অন্নছত্র ট্রাস্ট এস্টেটের নাম!

নবাবপুরের ১০৯ নাম্বার বাড়ি। প্রতিদিন দুপুর ১১টার পর এখানে ভীড় জমতে শুরু করে। অনাহারী মানুষেরা পরম আস্থায় এখানে ছুটে আসে। তারা জানে, এই শহরে আর কোথাও না হোক, এখানে অন্তত খাবার পাওয়া যাবে। কারা খাওয়াচ্ছে এই খাবার, কেনোই বা খাওয়াচ্ছে?

ব্রিটিশ আমলের কথা। তখন ঢাকা শহরে মাঝে মধ্যে দাঙ্গা লাগতো। দুর্ভিক্ষ হতো। ফলে অনেকেই খাবার না খেয়ে দিন কাটাত৷ এমনও হয়েছে, কত লোকে তো খাবার না খেয়ে মারাও গিয়েছে। মানুষ খাবারের অভাবে কষ্টে থাকবে, মারা যাবে এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারতেন না জমিদার মদনমোহন পাল। তিনি ছিলেন নবাবপুরের প্রজাহিতৈষী এক জমিদার। মানুষের কষ্টে তার মন

কেঁদে উঠতো।

 

 

তিনি ঠিক করলেন, প্রতিদিন কিছু লোককে খাবার খাওয়াবেন। শুরু করলেন ২০ জন দিয়ে। উদ্যোগটি টিকিয়ে রাখার জন্য সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করানোর কথা চিন্তা করলেন। আর তারপরই শুরু হলো অন্নছত্র ট্রাস্ট। মদনমোহন পাল নিজের সব সহায় সম্পত্তি লিখে দিলেন ট্রাস্টের নামে।

১৯২৪ সাল। মদনমোহন পালের সন্তান রজনীকান্ত পাল, মুরলীমোহন পাল, পিয়নাথ পাল আনুষ্ঠানিকভাবে “মদনমোহন অন্নছত্র ট্রাস্ট এস্টেট” গঠন করেন। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত নবাবপুরে ১৬৭ নাম্বার, যে বাড়িটা নিজেদের সেখানেই ট্রাস্টের কার্যক্রম চলতো। ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হওয়ার পর ঠিকানা বদলে যায়, নবাবপুরে ১০৯ নাম্বার বাড়িতে স্থানান্তর করা হয় ট্রাস্টের ঠিকানা।

মদনমোহন পালের তিন ছেলের নয়টা বাড়ি। সেই নয়টা বাড়িই এখন ট্রাস্ট্রের নামে। সেখানে মার্কেট, ভাড়া দিয়ে যা পাওয়া যাচ্ছে তা দিয়ে চালানো হচ্ছে ট্রাস্ট্রের কার্যক্রম। এই ট্রাস্টের দলিলে উল্লেখ আছে, মদনমোহন পালের বংশধররা পালাক্রমে এই ট্রাস্ট পরিচালনা করে যাবেন। যদি কোনো দিন এমন আসে, এই বংশে আর জীবিত কেউ নেই তাহলে প্রতিবেশী পাল বংশের মানুষদের ট্রাস্টি পরিচালনায় আনতে হবে, তবুও বন্ধ করা যাবে না এই জজ্ঞ।

কথায় আছে, পেট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি। অথচ, শুধু ক্ষুদা পেটে নিয়ে অশান্ত মনে কত মানুষ দিন কাটাচ্ছে গোটা পৃথিবীতে, তার কি হিসাব আছে? সেই হিসেবে বাংলাদেশের এই “মদনমোহন অন্নছত্র ট্রাস্ট এস্টেট” বিনামূল্যে গরীব, হতশ্রী, দুখী, ভিখারী, অর্ধাহারী, অনাহারীদের এতোগুলো বছর ধরে খাবার খাওয়াচ্ছে, শান্তির জন্য এর চেয়ে বড় কাজ আর কি হতে পারে? শান্তিতে নোবেল যদি কেউ সত্যিকার অর্থেই ডিজার্ব করে থাকে, তাহলে এই নোবেল মদনমোহন অন্নছত্র ট্রাস্ট এস্টেটকেই দেয়া উচিত।

অবশ্য নোবেল দিয়ে এই কাজের মূল্যায়ন হয়ত সম্ভবও না। কতটা বিরাট মন থাকলে, চুরানব্বই বছর একটা ট্রাস্ট শুধু মানুষকে এভাবেই সেবা দিয়ে যেতে পারে! এই ট্রাস্ট যদি কখনো নোবেল পায়, নিশ্চিত এই ক্ষুদাময় পৃথিবীর অনেক অনাহারীর মুখে খাবার দেয়ার জন্য হয়ত এমন আরো কিছু ট্রাস্টের জন্ম হবে। শুধু খাবার না পেয়ে কেউ মারা যাচ্ছে, কারো হাড়গোড় বেরিয়ে যাচ্ছে এসব কষ্টদায়ক দৃশ্য আর দেখতে হবে না কোনোদিন।

প্রতিদিন কমপক্ষে ১০১ জনকে খাবার দেয়া হয় এই অন্নছত্র ট্রাস্টের পক্ষ থেকে। কোনোদিন যদি পর্যাপ্ত লোক না আসে বেঁচে যাওয়া খাবার আশেপাশের ক্ষুদার্ত মানুষদের খুঁজে খুঁজে দেয়া হয়। অনেকসময় এমন হয়, মানুষ খাবার দেয়ার নির্ধারিত সময়ের পর আসেন। তখন ট্রাস্ট্রের কর্মরত লোকেরা নিজেদের ভাগের খাবার আগত ক্ষুদার্ত মানুষটা দিয়ে দেন। কারণ, ট্রাস্টের উইলে আছে, কাউকে ফেরানো যাবে না।

মদনমোহনের তিন ছেলে যারা ট্রাস্ট শুরু করেছিল তাদের মৃত্যুর পর তাদেরই বংশধর হীরালাল পাল, নিশিকান্ত পাল, বিজয়কৃষ্ণ পাল ও রাজবল্লভ পাল প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন। বর্তমানে প্রাচীন অন্নছত্র ট্রাস্টের ট্রাস্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন পাল বংশীয় দীপক কুমার পাল, তপন কুমার পাল ও মিন্টুরঞ্জন পাল। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তারা পূর্বপুরুষদের এ মহতী উদ্যোগের সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্ট রাখতে চান।

মদনমোহন পাল, অন্নছত্র ট্রাস্ট এস্টেট, বিনামূল্যে খাবার

অন্নছত্রে সেবক হিসেবে আছেন সুখরঞ্জন পাল। বয়স ৬৫। তাঁর বাবাও এখানে কাজ করতেন। বয়স হয়েছে বলে এখন ছেলেকেও নিয়ে এসেছেন তাঁকে সাহায্য করার জন্য। তবু তিনি প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থেকে খাবার বিতরণের তদারক করেন।

বর্তমান ব্যবস্থাপক পরিমল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য বললেন, “মানুষের কষ্ট দেখে তাঁদের (মদনমোহনের ছেলেদের) খুব খারাপ লাগে। তাই বাবার নামে মদনমোহন পাল অন্নছত্র ট্রাস্ট এস্টেট গঠন করলেন। নিজেদের নয়টা বাড়ি লিখে দিলেন ট্রাস্টের নামে। নয়টা বাড়ি এখন নয়টা মার্কেট। সেই আয় দিয়েই ট্রাস্ট চলছে। এখানে ধর্ম-জাত-পাতের কোনো ভেদাভেদ নেই। ক্ষুধার্ত অবস্থায় যিনি আসবেন, তিনিই খেতে পাবেন।”

এখানে এখন প্রতিদিন দুই আড়াইশো মানু্ষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা হয়। জাতপাতের আসলেই কোনো ব্যবধান নেই এখানে। তাই তো নবাবপুরে পাল পরিবারের শ্রীশ্রী রাধাশ্যাম জিউ ঠাকুর বিগ্রহ মন্দির ভবনে ১১টার পর মানুষ আসে, কতরকমের লোক, কার কি ধর্ম তাতে কিছু এসে যায় না। ক্ষুদার্ত মানুষকে সেবা দেয়া হচ্ছে, এটাই এখানকার বড় ব্যাপার। যে কেউই আসছেন ক্ষুদার্ত পেটে, কাউকেই ফেরানো হচ্ছে না। যিনি খাবার পরিবেশন করেন, তাকে অনেকে দাদু বলে ডাকে দেখে এই খাবারের নাম হয়ে গেছে কারো কারো কাছে দাদুর খাবার।

খাবারের মেন্যু খুব আহামরি না হয়ত, কিন্তু প্রচন্ড ভালবাসা আর আন্তরিকতা আছে সেখানে। পাচক স্বপন চক্রবর্তী বললেন, ৩৫ কেজি চাল, ১ মণ সবজি আর ৬ কেজি ডাল রান্না করেন তিনি। অন্নছত্রের শুরু থেকে এ তিনটি পদই রান্না হয়ে আসছে। খাবার মেন্যুতে থাকে সাদা ভাত, পাঁচ ধরনের সবজি দিয়ে তৈরি নিরামিষ ও ডাল। এখানে প্রতি মাসে একাদশীতে (চাঁদের একাদশ দিন) এবং শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী উপলক্ষে খাবার বন্ধ রাখা হয়। এছাড়া বাকি প্রত্যেকদিন খাবার খাওয়ানোর এই জজ্ঞ চলতেই থাকে, বন্ধ হয়না একটুও।

 

 

এই যুগে এসে এমন সেবা করার দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল। মানুষের চোখে যখন ভালবাসা দেখেন, তৃপ্তি দেখেন তখনই স্বার্থক হয়ে যায় ট্রাস্টের এই কর্ম। পরিমল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য একটা ঘটনা শুনালেন। বেশ কিছুদিন আগে ময়লা শার্ট, ছেঁড়া লুঙ্গি পরিহিত এক অনাহারী ব্যক্তি এখানে আসেন। ক্ষুধার কারণে মধ্যবয়সী ওই ব্যক্তি ভালোভাবে কথা বলতে পারছিলেন না। পেটে হাত দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেন তিনি ক্ষুধায় কাতর। কিন্তু প্রায় দুই ঘণ্টা আগে অন্নছত্রের খাওয়ানো শেষ হয়েছে। সেবকদের খাওয়াও শেষ। বাকি ছিলেন ব্যবস্থাপক পরিমল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য। হাঁড়িতে রাখা তার নিজের খাবার তিনি তখন ওই অনাহারীকে দিয়ে দেন। সেই লোকটাকে খাওয়াতে পেরে পরিমল নিজে যে তৃপ্তি পেয়েছেন তা একেবারে স্বর্গীয়, আর লোকটাও ভীষণ তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছিল সেদিন। টাকা তো অনেকের থাকে, কিন্তু এমন অনুভূতি নিয়ে কয়জন বাঁচতে পারে?

ট্রাস্টের আয়ের উৎস হচ্ছে নবাবপুর, পাটুয়াটুলী, সিদ্দিকবাজার এলাকার নয়টি মার্কেটের ভাড়া। এসব মার্কেটের দোকানের ভাড়াটিয়ারা সেই পুরোনো নিয়মে ভাড়া পরিশোধ করছেন। কেউ কেউ ভাড়া দিতে চান না। দখল নিয়ে ঝামেলা হয়। ফলে ট্রাস্ট্রের কার্যক্রম চলছে অনেক কষ্ট করেই৷ তবুও হাসিমুখে তারা এই কাজ করে যাচ্ছেন।

সুখরঞ্জন যেমনটা বললেন, “মানুষের সেবাই তো বড় ধর্ম। যে, যে ধর্মেরই হোক, তাদের সেবা করে মরতে পারলে জীবন ধন্য।”

Ref- http://egiye-cholo.com