বাংলাদেশে চালু হচ্ছে ফুড স্টিকার

SOHEL SOHEL

TALUKDER

প্রকাশিত: ৮:১৭ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ৬, ২০১৮

যেকোনো রেস্তোরাঁয় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান মানেই শাস্তি অবধারিত। অনেক চকচকে তকতকে রেস্তোরাঁয় গিয়েও দেখা যায়, রান্নাঘরের অবস্থা যাচ্ছেতাই। নোংরা পরিবেশে খাবারের ওপর দিয়ে তেলাপোকার অবাধ চলাফেরা যেন নিয়মিত স্বাভাবিক ব্যাপার। নিয়মবহির্ভূতভাবে ফ্রিজের মধ্যে রাখা হচ্ছে কাঁচা ও রান্না করা খাবার। মানুষ অনেকটা বাধ্য হয়েই যাচ্ছে এসব হোটেল-রেস্তোরাঁয়। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান ছাড়া সত্যিকার অর্থে এগুলোকে একটা কাঠামোর মধ্যে আনা বা একটা নির্দিষ্ট মান তৈরির জন্য কোনো আইন এত দিন ছিল না। এই পরিস্থিতিতে এবার শুধু খাদ্য ব্যবসায়ীদের জন্যই একটি নীতিমালা তৈরির কাজ করছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ)। পাশাপাশি হোটেল ও রেস্তোরাঁর কোনটা ভালো কোনটা খারাপ, তা বোঝার জন্য লাগানো হবে ‘ফুড স্টিকার’।

উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্যন্ত খাদ্যপণ্যের গুণগত মান যাতে ঠিক থাকে, তা নিশ্চিত করতেই নিরাপদ খাদ্য (খাদ্য ব্যবসায়ীদের বাধ্যবাধকতা) প্রবিধানমালা, ২০১৮-এর একটি খসড়া তৈরি করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। খসড়াটি বিএফএসএর ওয়েবসাইটে মতামতের জন্য দেওয়া হয়েছে। আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে যে কেউ এ বিষয়ে তাদের মতামত দিতে পারবে।

অবশ্য এলাকা ধরে হোটেল-রেস্তোরাঁর মান উন্নয়নের জন্য আরো আগেই কাজ শুরু করেছে বিএফএসএ। ঢাকার পল্টন-মতিঝিল এলাকার হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোর মধ্যে ১০০টিকে নিয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। মালিক ও কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ, রেস্তোরাঁয় কর্মচারীদের স্থান অনুযায়ী ড্রেস, হ্যান্ডগ্লাবস, দৃশ্যমান রান্নাঘর, যাদের রান্নাঘর চোখের সামনে পড়ে না, তাদের রান্নাঘরে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়ে মনিটরে সবার সামনে দেখানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে।

যেসব হোটেল-রেস্তোরাঁ সব ধরনের স্ট্যান্ডার্ড মেনে পরিচালিত হবে সেগুলোকে সবুজ, যেগুলোতে কিছু সমস্যা থাকবে, তবে একটু সময় নিয়ে উন্নয়ন করা সম্ভব সেগুলো হলুদ এবং যেগুলোর মান ভালো নয় এবং সহজে ঠিক করাও সম্ভব নয় সেগুলোকে লাল চিহ্নিত করে স্টিকার লাগিয়ে দেওয়া হবে। এই ‘ফুড স্টিকার’ দেখে মানুষ হোটেল-রেস্তোরাঁয় ঢোকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।

জানা গেছে, ওই ১০০টি হোটেল-রেস্তোরাঁর মধ্যে মাত্র চারটি সবুজ স্টিকার পেয়েছে। আর ৪৫টি হলুদ ও ৫১টিতে লাল স্টিকার সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে। হলুদ ও লাল স্টিকারধারীদের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে মানোন্নয়নের জন্য। কেউ তা না পারলে বন্ধ করে দেওয়া হবে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হোটেল-রেস্তোরাঁর উন্নয়নে যে কাজটা শুরু হয়েছে এবং সেটা ধরে রাখতে যে প্রবিধান তৈরি করা হচ্ছে, তা খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে যারা একবার মানোন্নয়ন করে সবুজ স্টিকার পাবে, তারা যেন আর কখনো সেই মানের নিচে নামতে না পারে সে জন্য নিয়মিত মনিটর করতে হবে। না হলে উদ্যোগটাই ভেস্তে যেতে পারে।’ ভোক্তারা এটাকে সাধুবাদ জানাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্টিকার দেখে মানুষ হোটেলে ঢোকা শুরু করলে বাজে হোটেলগুলো এমনিতেই নিজেদের মানোন্নয়নে বাধ্য হবে।

বিএফএসএ বলছে, ছড়ি ঘুরিয়ে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা নয়, বরং একটা স্ট্যান্ডার্ড তৈরির জন্য খাদ্য ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স নিতে হবে। নতুন যারা এ ব্যবসায় যুক্ত হবে তাদেরকে নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড মেনে তবেই আসতে হবে। আর পুরনোদেরকে পর্যায়ক্রমে ব্যবসার স্থাপনা, খাদ্যপণ্যের উৎপাদন পরিবেশ এবং মানের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

প্রবিধানমালার খসড়ায় পাঁচ বছর মেয়াদে লাইসেন্স দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। স্থাপনা ও ব্যবসার জন্য আলাদা আলাদা ফরমে রেজিস্ট্রেশনের আবেদন করতে হবে।

প্রবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ও বিএফএসএর সদস্য মাহবুব কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘লাইসেন্স বা রেজিস্ট্রেশন মানেই ব্যবসায়ীদের ওপর ছড়ি ঘোরানো নয়; তাদেরকে নিয়মের মধ্যে আনা। পুরনোদের ধীরে ধীরে এ প্রক্রিয়ায় অনার কাজ চলবে। তবে নতুন করে যারা এ ব্যবসায় আসবে তাদের যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে তবেই নিবন্ধন নিতে হবে। সেটা দেওয়া হবে সরেজমিন পরিদর্শন শেষে।’

হোটেল-রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের এখন বেশ কয়েকটি লাইসেন্স নিতে হয়। ট্রেড লাইসেন্স, পর্যটন করপোরেশনের লাইসেন্স, ফায়ার সেফটি ও ভ্যাটের লাইসেন্স। এর বাইরে নতুন আরেকটি লাইসেন্স ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ তৈরি করবে না, যদি প্রক্রিয়া সহজ হয় এবং সেটি সত্যিকার অর্থেই একটি স্ট্যান্ডার্ড তৈরির জন্য করা হয়।

বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার রুহুল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হয়রানির উদ্দেশ্য থেকে বেরিয়ে নিয়মের মধ্যে হলে এটা আমাদের ওপর চাপ তৈরি করবে না। বরং আমাদের জন্য ভালোই হবে।’

জানা গেছে, প্রবিধানটি পাস হওয়ার পর থেকে যেনতেনভাবে কেউ খাবারের ব্যবসায় আসতে পারবে না। নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন মেনে স্থাপনা তৈরি করতে হবে। হোটেল রেস্টুরেন্ট হলে একরকম আর খাদ্য উৎপাদনকারী হলে তাদের কারখানার স্থাপনা কেমন হবে তা কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হবে। খাদ্য ব্যবসার সঙ্গে যায় না, এমন ত্রুটিপূর্ণ স্থাপনার অনুমোদনই দেওয়া হবে না। প্রবিধানে শুধু লাইসেন্স নয়, খাদ্য ব্যবসায়ীদের সামগ্রিক বিষয়ের ওপর বিস্তারিত বলা হয়েছে। কিভাবে বিজ্ঞাপন দেওয়া যাবে বা যাবে না, খাদ্য ব্যবসায়ীর দায়িত্ব, নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, পরিদর্শন কার্যক্রম, অনিরাপদ খাদ্য দ্রুত কিভাবে খুচরা দোকানি বা ভোক্তার কাছ থেকে দ্রুত ফিরিয়ে আনা যায়, উৎস শনাক্তকরণ, মজুদকরণ, বিতরণ ব্যবস্থা, ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ, স্থাপনার শ্রেণিবিন্যাস, নিবন্ধন বাতিলের বিধানসহ পাঁচটি অধ্যায়ে ভাগ করে বিস্তারিতভাবে থাকছে এতে।

প্রয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে খসড়ায় বলা হয়েছে, আমদানি ও বিক্রয়সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমসহ খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত, প্রস্তুত, মোড়কজাত, পরিবহন, গুদামজাত, বিতরণ, প্রদর্শন ও বিপণনের সব পর্যায়কে ধরেই এ বিধিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে। সব ধরনের হোটেল-রেস্টুরেন্ট, খাদ্যপণ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত সব শিল্প-কারখানা এবং আমদানিকারকরা এই প্রবিধানের আওতায় আসবে।

তবে বিধি ভঙ্গের দায়ে প্রবিধানে কোনো শাস্তির বিষয়ে উল্লেখ করা হয়নি। নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩-এর সংশ্লিষ্ট ধারা মোতাবেক বিভিন্ন অপরাধের শাস্তিই এখানে কার্যকর হবে।

সূত্র- কালের কণ্ঠ