বাংলাদেশের অ্যাডভেঞ্চার ম্যান শিশির !

প্রকাশিত: ৩:৫৯ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৯

নিজস্ব প্রতিবেদক :

শুধু দেশের দুর্গম স্থানগুলোই নয়, বিদেশের জলে-জঙ্গলেও দাপিয়ে বেড়ান। বন্যপ্রাণীর সঙ্গে তাঁর তুমুল সখ্য। অনায়াসে বন্ধুত্ব করতে পারেন কিং কোবরার সঙ্গেও। ডিসকভারি চ্যানেলে বেয়ার গ্রিলসের ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ দেখে মাথায় চাপে দুর্গম স্থান চষে বেড়ানোর ভূত। আর আজ তিনি বাংলাদেশের ‘অ্যাডভেঞ্চার ম্যান’!

 

বলছি শিশির সালমানের কথা। ২০০৩ সালে দেশের সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলগুলোতে শুরু করেন তাঁর অভিযান। সঙ্গে ক্যামেরা ও কয়েকজন সঙ্গী। দুর্গম যাত্রাকে ক্যামেরাবন্দি করেন। শুধু পাহাড়-পর্বতেই নয়, নদী-সাগরেও তাঁর অবাধ বিচরণ।

 

ব্যক্তিগতভাবে নিজের দুর্গমযাত্রার বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহে থাকলেও পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন ২০১২ সালে, যখন জনপ্রিয় বেসরকারি টিভি চ্যানেল এনটিভি সম্প্রচার করে তাঁর শো ‘অ্যাডভেঞ্চার ম্যান’। সেই থেকে শিশির সালমান পার করেছেন এই শোর চার মৌসুম। এরই মধ্যে সম্প্রচারিত হয়েছে সাড়ে চারশ পর্ব।

 

শুক্রবার (৮ ফেব্রুয়ারি) এনটিভিতে শুরু হয়েছে ‘অ্যাডভেঞ্চার ম্যান’-এর পঞ্চম মৌসুম। দেখানো হয়েছে ৪৫১তম পর্ব। প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে সম্প্রচার করা হবে এই রোমাঞ্চকর শো।

 

প্রতিটি পর্বে অ্যাডভেঞ্চার ম্যান শিশির এমন কোনো দুর্গম স্থানে যান, যেখানে সাধারণত মানুষ যান না। এমন স্থানও দেখান, যেখানে মানুষের পায়ের ছাপ মেলা ভার। অথবা সেই স্থানটি প্রথমবারের মতো দেখছেন এনটিভির দর্শক, যেখানে বেঁচে থাকার সঠিক কানুনটি জানা না থাকলে, সেই দুঃসাহস না থাকলে বেঁচে ফেরা কঠিন।

 

এই পথ চলতেই দেখা হয় নানা জীবজন্তুর সঙ্গে। যদিও সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, পাহাড়ে হাতি আর সাপ ছাড়া বাংলাদেশের জঙ্গলে ‘ভয়ংকর’ প্রাণীর দেখা মেলা ভার। তবে কোনো প্রাণীকেই ভয়ংকর বলতে নারাজ শিশির। তাঁর মতে, ‘জঙ্গলে মানব ছাড়া আর কোনো দানব নেই!’

 

বান্দরবানের থানচি উপজেলার আন্ধারমানিক শব্দটিই রহস্যময়। সালমান জানালেন, রুমা উপজেলার রাইখ্যং লেক বা পুকুরপাড়া পার হয়ে দুই হাজার ফুট উঁচু দুর্গম অঞ্চল পাড়ি দিয়েছেন তিনি। একই লেক পার হয়ে দুমলংয়ে পৌঁছেছেন সালমান, যেটি প্রায় তিন হাজার ৩১৪ ফুট উঁচু পাহাড়ি এলাকা। এত উঁচু থেকে চর্মচক্ষে নৈসর্গিক সৌন্দর্যে যে কেউ আপ্লুত হলেও পৌঁছাতে হয় বহু দুর্গম অঞ্চল পাড়ি দিয়ে, দিনরাত হেঁটে।

 

অনেক প্রতিকূলতার মুখেও পড়েছেন অ্যাডভেঞ্চার ম্যান। যেখানে তিন দিনে পৌঁছাবেন ভেবে স্থির করেছিলেন লক্ষ্য, সেখানে এমনও হয়েছে লেগেছে ১৭ দিন! যেখানে মুঠোফোনের সংযোগটিও বিচ্ছিন্ন।

 

‘তিন দিনের নাম করে আমরা চারজন বেরিয়েছিলাম। সে জায়গায় হয়ে গেছে ১৭ দিন। এদিকে মোবাইলের নেটওয়ার্কও নেই। যোগাযোগ করার উপায় নেই। বাড়িতে কান্নাকাটি শুরু হয়ে গিয়েছিল,’ এনটিভি অনলাইনকে বললেন শিশির।

 

এমন নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতা রয়েছে সালমানের ঝুলিতে। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। নীরব-নিঃশব্দ জঙ্গলে সাপ-পোকামাকড়ের সঙ্গে কাটিয়েছেন রাত। প্রায় ১৮ বছর এ দুর্গমযাত্রার সঙ্গী হলেও আজও তাঁর অভিযানের নেশা কাটেনি।

 

২০১৭ সালে নেপাল অভিযানের সময় সালমানের দুই হাতের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। প্রায় ছয় মাস তাঁর শোর কাজ বন্ধ থাকে। বাংলাদেশের প্রায় সব দুর্গম পাহাড়ি এলাকাসহ নেপাল, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জঙ্গলও তিনি চষে বেড়িয়েছেন। ভবিষ্যতে আমাজন জঙ্গলসহ আরো অনেক দেশের জঙ্গলে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে শিশির সালমানের।

 

শিশির জানালেন, পার্বত্য অঞ্চলে হাতি, ভালুক, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, গয়াল বা বন্যগরু, বনমোরগ বা মুরগি, ময়নাপাখি ইত্যাদিই বেশি দেখা যায়। দেশের বাইরের জঙ্গলগুলোর মতো প্রাণীবৈচিত্র্য নেই। আর এর জন্য তিনি দুষছেন রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অভাবকে। গাছপালাও তুলনামূলক কমে গেছে।

 

আক্ষেপ করে শিশির বলেন, ‘একসময় আমাদের দেশে গণ্ডার ছিল, ময়ূর ছিল, এখন নেই। এখনো হাতি টিকে আছে। সরকার যদি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেয়, তবে যা আছে তা-ও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’

 

আর এই ‘অ্যাডভেঞ্চার ম্যান’ শোটির উদ্দেশ্য?

‘বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকায় প্রতিবছর কয়েক লাখ পর্যটক বেড়াতে আসেন। তাঁদের সবাই সুস্থভাবে ফিরে যান না বা যেতে পারেন না। প্রতিবছরই বেশ কিছু পর্যটক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রাণ হারান। আমার এই শোতে দেখানোর চেষ্টা করি কীভাবে দুর্গম ও কঠিন পরিবেশে বেঁচে থাকতে হয়। এবং যেখানে জনমানবহীন অঞ্চল, বেঁচে থাকার জন্য কী কী খাওয়া যেতে পারে ইত্যাদি,’ বলেন শিশির।

 

শিশিরের এই অভিযানের সঙ্গী ছয়জন। ক্যামেরায় রিংকু, আলমগীর ও মিতু মৌসুমী; ক্যামেরা সহযোগী মুন্না ও বাবু আর প্রডাকশন সহযোগী জিয়াউল হক। ভিডিও সম্পাদনা করেন রিনা আক্তার ও সালমান নিজেই। শিশিরের এই অভিযানের পৃষ্ঠপোষক স্টেপ ফুটওয়্যার লিমিটেড।

 

বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, পাংখোয়া, বমসহ নানা নৃগোষ্ঠীর মানুষের বাস। পর্যটক ও অভিযাত্রীদের প্রতি সালমানের অনুরোধ, পাহাড়ি মানুষের সঙ্গে যেন কেউ এমন কোনো আচরণ না করেন, যাতে তাঁদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।