পৃথিবী থেকে পোলিও নির্মূলের অন্যতম নায়ক বাংলাদেশের আমজাদ

প্রকাশিত: ৫:০১ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৮, ২০১৮

‘আমজাদ পৃথিবী থেকে পোলিও নির্মূলের অন্যতম এক নায়ক’। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশ্বের অন্যতম সেরা ধনী বিল গেটসের এই প্রশংসাবাণী যাকে নিয়ে, তিনি বাংলাদেশের ছেলে এএসএম আমজাদ হোসেন।
গত বছর স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন থেকে গেটস ভ্যাকসিন ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড পান ঢাকার ছেলে আমজাদ হোসেন। শিশুদের পোলিও টিকা দেওয়া নিশ্চিত করার কাজে নিজস্ব মেধা ও কৌশল অবলম্বনের স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরস্কার দেওয়া হয় তাঁকে। শুধু বাংলাদেশ নয়, আমজাদ তাঁর সাফল্যের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বজুড়ে।
বাংলাদেশের জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির একজন জেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু সদাবিনয়ী এএসএম আমজাদ হোসেন চেয়েছিলেন আরও বড় কিছু করতে। তিনি সেই শুরু থেকে বিশ্বাস করতেন, মাহাথির মোহাম্মদের সই বিখ্যাত উক্তি: ‘কোনো সমস্যা এলে ভয় পেয়ে তাকে এড়িয়ে গেলে হবে না। তা মোকাবিলা করা, সমস্যার উৎস খুঁজে বের করা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ।’
মাহাথিরের ওই উক্তিকেই নিজের কাজের মূল প্রেরণা হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন তিনি। সাফল্যের সঙ্গে পেরিয়ে গেছেন জীবনের একেকটি ধাপ।
আমজাদ হোসেনের জন্ম ১৯৭২ সালে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার পূর্ব খইয়াছড়া গ্রামে। সরকারি চাকরিজীবী বাবা আখতারুজ্জামান ও মা নিলুফার আখতারের চার ছেলেমেয়ের মধ্যে আমজাদই সবার বড়। ঢাকার মিরপুরের মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় হাতেখড়ি নেন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনস্বাস্থ্যের ওপর আরও উচ্চতর শিক্ষা নেন।
২০০৩ সালে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে আমজাদ চলে যান টাঙ্গাইলে। টাঙ্গাইলে সম্প্রসারিত টিকাদান প্রকল্পে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়ে দেখলেন, অনেক শিশুই জন্মের পর টিকা নেয় না। চার থেকে ছয় মাস পরও অনেকে টিকা নেয়। তিনি তাঁর সহকর্মীদের বললেন প্রতিটি গ্রামের গর্ভবতী নারীদের একটি তালিকা করতে। কোন মাসে কোন গ্রামে কোন কোন নারীর সন্তান জন্ম নেবে, তার একটি তথ্যভান্ডার গড়ে তুললেন তাঁরা। সন্তান ভূমিষ্ঠের পরই তাঁরা হাজির হয়ে যেতেন। কেউ টিকা থেকে বাদ পড়ল কি না, তা জানতে একটি মূল্যায়ন কৌশলও (চেকলিস্ট) তৈরি করলেন আমজাদ। সুফল মিলল অচিরেইএএসএম আমজাদ হোসেনএএসএম আমজাদ হোসেন
আমজাদের এই আপাতসাধারণ কৌশল প্রয়োগের দুই বছরের মাথায় টাঙ্গাইলে টিকা নেওয়া শিশুদের সংখ্যা ২০ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে যায়। আমজাদের পরের অভিযান ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ। সাফল্য এল সেখানেও। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির পক্ষ থেকে এই কৌশল ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ জেলায় প্রয়োগ করা হলো। ওই দুই জেলাতেও টিকাদানের হার ১৭ দশমিক ৪ ও ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে গেল।
তারপর ডাক এল বিদেশ থেকে। কাজের টানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক হিসেবে নাইজেরিয়া ছুটে গেলেন তিনি। সেখানেও বাজিমাত করল তাঁর বিশেষ টিকাদান নিশ্চিতকরণ কৌশল। তারপর এল স্বীকৃতি। তিনি পান বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের প্রথম গেটস ভ্যাকসিন ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড।
গত এপ্রিল মাসে মরু-শহর আবুধাবিতে সারা বিশ্বের ৪০০ জন বিজ্ঞানী ও গবেষক নিয়ে হয়ে গেল বিশ্ব ভ্যাকসিন সম্মেলন। আমজাদ হোসেনকেও ওই সম্মেলনে আলোচনার জন্য ডাকা হয়। সেখানেই বিল গেটস মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্ভাবনী চিন্তার উদাহরণ দিতে গিয়ে আমজাদের প্রশংসা করেন। আমজাদ বলেন, ‘তিনি এত বড় মাপের মানুষ। নিজেই এসে ডেকে কথা বললেন। তিনি আমার কাজ সম্পর্কে জানতে খুবই আগ্রহী ছিলেন।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক হিসেবে নাইজেরিয়ায় কাজ করা আমজাদের কাজের খোঁজখবরও নেন বিল গেটস। আরব আমিরাতের জনপ্রিয় সংবাদপত্র গালফ নিউজসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিল গেটসের পাশাপাশি আমজাদের উপস্থিতির খবর প্রচারিত হয়।
বাংলাদেশে শুরু হওয়া আমজাদের এই কৌশল অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে বলে মনে করে গেটস ফাউন্ডেশন। তাঁর কাজের ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের গেটস পুরস্কারটি মোজাম্বিকের মাঠপর্যায়ে কাজ করা স্বাস্থ্যকর্মী মার্গারিডা মাটসিনিকে দেওয়া হয়।
টিকাদান কর্মসূচি মাঠপর্যায়ে সফলভাবে বাস্তবায়নের অগ্রপথিক আমজাদের কাজের পদ্ধতি এখন নাইজেরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রয়োগ হচ্ছে। তাঁর তত্ত্বাবধানে নাইজেরিয়ার টিকাদান কর্মসূচিতে ইতিমধ্যে সাফল্যও আসতে শুরু করেছে। দেশটির বেশির ভাগ মানুষ এত দিন পোলিওসহ অন্যান্য টিকার আওতার বাইরে ছিল। বর্তমানে সেখানকার ৫০ শতাংশ শিশু টিকার আওতায় চলে এসেছে।

নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলতে গিয়ে নাইজেরিয়া থেকে মুঠোফোনে আমজাদ হোসেন জানান, মা-নবজাতক ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবাকে সমন্বিত করার পরিকল্পনা নিয়েছেন তিনি। এই পদ্ধতি বাংলাদেশে প্রয়োগের মহা-পরিকল্পনা নিয়ে দেশের ছেলে ফিরে আসতে চান দেশেই।

সূত্র – প্রথম আলো