হাত-পা ছাড়াই পুরো স্কুলে মেধাতালিকায় প্রথম

SOHEL SOHEL

TALUKDER

প্রকাশিত: ৪:৫৩ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৮, ২০১৮

যশোরের মণিরামপুরের লিতুন জিরার হাতও নেই, পা-ও নেই। কিন্তু কী আশ্চর্য! শুধু ক্লাসেই নয়, সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে স্কুলেও সে ফার্স্ট।

সেদিন ছিল বুধবার। সকাল সাড়ে ১০টা। যশোরের মণিরামপুর উপজেলার খানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণি। চলছে গণিতের জ্যামিতি ক্লাস। হাত-পা নেই, তাতে কী! অবলীলায় মুখ দিয়ে লিখে চলেছে লিতুন জিরা, আঁকছে জ্যামিতিক চিত্র।

যশোরের মণিরামপুর উপজেলা সদর থেকে অন্তত আট কিলোমিটার পূর্ব দিকে খানপুর ইউনিয়ন। ওই ইউনিয়নের একটি গ্রাম শেখপাড়া খানপুর। ২০০৮ সালের ২৫ জুন ওই গ্রামের দরিদ্র হাবিবুর রহমান ও জাহানারা বেগমের ঘরে জন্ম নিল একটি কন্যা শিশু। শিশুটির হাত-পা নেই বললেই চলে। বিচলিত হলেও ভেঙে পড়েননি এই দম্পত্তি। তাঁদের সাহস জোগালেন হাবিবুর রহমানের পিতা জোনাব আলী সরদার। শিশুটির নাম রাখা হলো লিতুন জিরা।

প্রথম দিকে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। কষ্ট ও দুঃখের মধ্যে বড় হতে হতে অনেক কিছুই বুঝতে শিখল লিতুন জিরা। এটাও বুঝল তার মেধা, বুদ্ধি অন্য স্বাভাবিক শিশুর তুলনায় অনেক বেশি। গ্রামের লোকেরাও আস্তে আস্তে ভালোবেসে ফেলে লিতুন জিরাকে। পরিবারের লোকেরা ভর্তি করে দিল পাড়ার মক্তবে। অল্প দিনের মধ্যেই কোরআন শরিফ পড়া শিখে ওস্তাদ সোহরাব হোসেনকে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিল ছোট্ট মেয়েটা। তার কোরআন তেলাওয়াতও খুব সুন্দর। এবার মা-বাবা লিতুন জিরাকে বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্ক শেখাতে লাগলেন বাড়িতে।

২০১৪ সালে খানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বাড়ি বাড়ি শিশু জরিপ করতে গিয়ে দেখা পান লিতুন জিরার। তার মেধার গল্প শুনে স্কুলে ভর্তি করার জন্য বলেন তাঁরা। উত্সাহী মা-বাবা নিয়ে গেলেন স্কুলে। প্রধান শিক্ষক লিতুন জিরাকে কিছু লিখতে বললেন। সঙ্গে সঙ্গে হাতের বাহুর অংশটা দিয়ে কলম মুখে তুলে লিখে দিল স্বাভাবিক শিশুর চেয়ে দ্রুত ও সুন্দর করে। অবাক শিক্ষকরা প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করে নিলেন লিতুন জিরাকে। ২০১৫ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত হলো সে। এ ধারা অব্যাহত রেখে ২০১৭ সালের তৃতীয় শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে আবারও প্রথম হয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে উঠে লিতুন জিরা। তার প্রাপ্ত নম্বর স্কুলের সব শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ হওয়ায় স্কুল ফার্স্ট হিসেবে স্বীকৃতি পেল সে। লিতুন জিরার স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাজেদা খাতুন বলেন, ‘২০১৭ সালের তৃতীয় শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় ৬০০ নম্বরের মধ্যে ৫৮০ নম্বর পেয়ে ক্লাসে ও স্কুলের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে চতুর্থ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে সে। এবারও ভালো ফলাফল করবে বলে আমার বিশ্বাস।’

২০১৪ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের অধীনে শিক্ষার প্রথম স্তর পরীক্ষায় খুলনা বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান লাভ করে লিতুন জিরা। কিন্তু বিভাগীয় কর্মকর্তারা যখন জানতে পারেন প্রথম স্থান অধিকার করা মেয়েটির হাত-পা কিছুই নেই, রীতিমতো সংশয়ে পড়ে যান তাঁরা। পরে ওই কর্মকর্তারা পরিদর্শনে এসে আবার তার পরীক্ষা নেন। এতে ভালো ফল করে কর্মকর্তাদের অবাক করে দেয় লিতুন জিরা।

কয়েক দিন আগে লিতুন জিরার বাড়িতে গিয়ে জানতে পারলাম, মায়ের সঙ্গে হুইল চেয়ারে করে স্কুলে গেছে সে। স্কুলে গিয়ে দেখা গেল শ্রেণিকক্ষে খুব মনোযোগের সঙ্গে ক্লাস করছে। পাঠদান করছিলেন প্রধান শিক্ষক নিজেই। ক্লাস শেষে কথা হয় লিতুন জিরার সহপাঠী বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে। বান্ধবী মুন্নী আক্তার জানাল, ‘লিতুন জিরা আমাদের ভালো বন্ধু। কোনো কিছু না বুঝলে তার কাছ থেকে বুঝে নিই।’ লিতুন জিরা বলল, ‘কারো বোঝা হতে চাই না। লেখাপড়া শিখে বড় মানুষ হতে চাই।’

 

লিতুন জিরার মা জাহানারা বেগম জানান, ‘লিতুন এখন নিজের কাজ প্রায় সব নিজেই করতে পারে। ওর ইচ্ছাশক্তি প্রবল। আমরা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। ওর বাবা ১৫ বছর ধরে বিনা বেতনে স্থানীয় একটি কলেজে চাকরি করছেন। কলেজটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় আমরা বড় অসহায়। আমি নিজেই ডিগ্রি পাস করে বেকার বসে আছি। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও প্রতিবন্ধী সন্তানসহ কৃষিজীবী বৃদ্ধ শ্বশুরের সংসারে বোঝা হয়ে আছি। বছর পাঁচেক আগে উপজেলা প্রশাসন থেকে একটি হুইল চেয়ার মেয়েটিকে দিয়েছিল। এটাও এখন বেহাল।’

কথা হলো লিতুন জিরার পিতা হাবিবুর রহমানের সঙ্গেও। লিতুন জিরার রেজাল্ট, লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ, ধৈর্য দেখে আশা জাগে তাঁর মনে। ভালোভাবে লেখাপড়া শিখিয়ে ওর ইচ্ছা পূরণ করতে চান। তবে লিতুন জিরার উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি চিন্তিত। অর্থনৈতিক দুর্বলতাই এর কারণ।

লিতুন জিরা কিন্তু খুব স্পর্শকাতর। জানতে চেয়েছিলাম তার জীবনের আনন্দ আর দুঃখের ঘটনা। বছর দুয়েক আগের কথা, কোনো কারণে মা জাহানারা বেগম লিতুন জিরাকে মারেন। এতে সে মনে খুব কষ্ট পায়। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়ে সারা দিন কান্নাকাটি করে। লিতুন জিরা মনে করে, সে যদি প্রতিবন্ধী না হতো তাহলে তাকে হয়তো কারো বকা শুনতে হতো না। সবাই তাকে অবহেলা করে এ ধরনের একটা কষ্টও আছে মনে। এ তো গেল দুঃখের ঘটনা। এদিকে গত বছর ইউনিয়ন পর্যায়ে আন্ত স্কুল বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় উপজেলার ছিলুমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ওই প্রতিযোগিতায় লিতুন জিরা কবিতা আবৃত্তি ও দেশাত্মবোধক গানে প্রথম হয়। লিতুন জিরা জানায়, এটা তার জীবনের আনন্দময় ঘটনাগুলোর একটি। পড়ালেখার পাশাপাশি গান, আবৃত্তি এসবও চালিয়ে যেতে চায় ছোট্ট মেয়েটি। আগামী মাসে তার খুলনা বেতারে গানের অডিশনে যাওয়ার কথা।