ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায়

SOHEL SOHEL

TALUKDER

প্রকাশিত: ১২:১২ পূর্বাহ্ণ, জুন ২৯, ২০২০

‘ডিপ্রেশন’। মনখারাপ বলে যাকে অনেকেই এত দিন দূরে সরিয়ে রেখে এসেছেন। কিন্তু মনখারাপ আর ডিপ্রেশন কি এক? কোনও কারণে অনেকেরই দু’চার দিন মনখারাপ থাকতে পারে। তবে যদি দেখেন যে, সেই মনখারাপ থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না, ক্রমশ তা গ্রাস করছে আপনার অস্তিত্বকে, তখনই কিন্তু সচেতন হতে হবে। 

ডিপ্রেশনের লক্ষণ
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘‘মেজর ডিপ্রেসিভ ডিজ়অর্ডার আছে কি না তা বোঝার জন্য দুটো মুখ্য উপসর্গ আছে। প্রথমত দেখতে হবে, এটা মনখারাপ নাকি ডিপ্রেশন?  মনখারাপ দু’-এক দিনে ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু মনখারাপ যদি দু’সপ্তাহ বা তার বেশি স্থায়ী হয়, তা হলে বুঝতে হবে তা ডিপ্রেশনের দিকে এগোচ্ছে। আর একটা দিকও দেখতে হবে, তিনি সব কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন কি না। হয়তো তিনি সিনেমা-সিরিজ় দেখতে ভালবাসেন, গান ভালবাসেন, কিন্তু এখন সেটা আর ভাল লাগছে না। বা কেউ হয়তো রান্না করতে, খেতে ভালবাসেন, সেটাও আর ভাল লাগছে না। এই দু’টি দিক বা এদের যে কোনও একটি লক্ষণ থাকলেই বুঝতে হবে, মনে ডিপ্রেশন বাসা বাঁধছে। এর সঙ্গেই কিছু লক্ষণ নজর রাখতে হবে।’’
•ঘুম কমে যাওয়া বা অতিরিক্ত ঘুমোনোও অন্যতম লক্ষণ।

•লস অফ এনার্জিও দেখা দিতে পারে। তবে তখন তা খতিয়ে দেখতে হবে যে, এটা মানসিক কারণে হচ্ছে নাকি শারীরিক সমস্যা থেকে হচ্ছে। অনেক সময়ে থাইরয়েড বা অন্যান্য অসুখের কারণেও এনার্জি থাকে না।

•এর সঙ্গেই অহেতুক অপরাধবোধ দেখা দেবে। তিনি নিজেকে সব ব্যাপারে দোষী ভাবতে শুরু করবেন।

•সব বিষয়ে মনোযোগও কমতে থাকবে। একটানা কোনও কাজ করতে পারবেন না।

•আর মুভমেন্ট কমবে বা অতিরিক্ত বাড়বে। হতে পারে, কেউ সারা দিন একটা ঘরে শুয়েই থাকলেন। আবার হতে পারে কেউ চিন্তা করতে করতে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে পায়চারি করে গেলেন।

•সারা দিনের কাজের পরিকল্পনা বা কোন কাজকে প্রাধান্য দেবেন, তা-ও নির্ধারণ করতে পারবেন না।

•আত্মহত্যা করার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে। খুব কম ক্ষেত্রে হলেও কিছু ঘটনা দেখা গিয়েছে যে, রোগী নিজের উপরে নির্ভরশীলদেরও মেরে ফেলার কথা ভাবতে পারেন।

মনখারাপের স্থায়িত্ব, আগ্রহ হারিয়ে ফেলার সঙ্গে এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিলেই বুঝতে হবে যে, ডিপ্রেশন তাঁকে গ্রাস করছে। তখনই কিন্তু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। অনেক সময়ে বন্ধুবান্ধব বা মা-বাবার কাছে রোগী স্বীকার করেন যে, তাঁর মন ভাল নেই। তখন অনেকেই ভাবেন, ওর কীসের অভাব আছে? বা কী এমন ঘটেছে যে মন ভাল নেই কেন? এ সব ভেবে তা উড়িয়ে দেন। কোনও অভাব না থাকলেও ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে একটি
মানুষের জীবন ঠিকঠাক চলছে মনে হলেও কিন্তু ডিপ্রেশন বাসা বাঁধতে পারে তাঁর মনে।

নিজে থেকে ডিপ্রেশন কমে?

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রুদ্র আচার্যর কথায়, ‘‘মাইল্ড ডিপ্রেশন হলে কিছু ক্ষেত্রে রোগী বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কথা বলে হয়তো অবসাদ কাটিয়ে উঠল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞের পরামর্শ দরকার। কারণ যাঁর একবার ডিপ্রেশন দেখা দেবে, তার কিন্তু অবসাদ আবার দেখা দেওয়ার প্রবণতা থাকে।’’

রোগনির্ণয়

অনেক সময়ে রোগী নিজেই বুঝতে পারেন যে, তিনি ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার রোগী তা বুঝে উঠতে পারেন না। তখন কিন্তু আশপাশের মানুষকে সচেতন হতে হবে। অবসাদ গ্রাস করতে শুরু করলে সোশ্যাল উইথড্রয়াল বা আইসোলেশনের প্রবণতা দেখা দেয়। সেটা কিন্তু রোগী বুঝতে না পারলেও তার পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের বোঝা উচিত। যে মানুষটা এত দিন সকলের সঙ্গে আড্ডা দিতেন, তিনি হঠাৎ মেলামেশা বন্ধ করে দিলে বা বাড়িতেই ক্রমাগত গুটিয়ে যেতে থাকলে আশপাশের মানুষকে পদক্ষেপ করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। তবে প্রিয়জনের কাছে মনের আগল খুলতে পারেন। ডা. আবির মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আমাদের দেশে সায়কায়াট্রিস্ট ও সাইকোলজিস্টের সংখ্যা কম। অন্য দিকে ডিপ্রেসিভ ডিজ়অর্ডার পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। সে ক্ষেত্রে চট করে সায়কায়াট্রিস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট না-ও পেতে পারেন। কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকলে সমস্যা বাড়তে পারে। তাই বন্ধু, মা-বাবা, আস্থাভাজন কারও সঙ্গে কথা বলুন। এ ক্ষেত্রে কথা বলা জরুরি। ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের পরামর্শ নিন। মেন্টাল হেল্থ প্রফেশনালের সাহায্যও নিতে পারেন।’’

চিকিৎসা

রোগীর সঙ্গে কথা বলে কাউন্সেলিং শুরু করা হয়। একই সঙ্গে তাঁর ডায়াবিটিস, থাইরয়েড, অ্যানিমিয়া বা অন্যান্য রোগ আছে কি না সেই টেস্টও করা হয়। তবে পরীক্ষা করার আগেই কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু করা হয়। যদি দেখা যায় যে, পেশেন্ট অ্যাকিউট ডিপ্রেশনে ভুগছেন, তখন টেস্ট করার জন্য অপেক্ষা করা হয় না। কাউন্সেলিং করে, কিছু ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা হয়। ডিপ্রেশনের ওষুধ দীর্ঘমেয়াদি। ডিপ্রেশনের এপিসোড একবার দেখা দিলে ছ’মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত ওষুধ খেতে হবে। দু’বার বা তার বেশি বার দেখা দিলে সেই ওষুধের মেয়াদ আরও বাড়বে, কিছু ক্ষেত্রে সারা জীবন খেতে হতে পারে। পাশাপাশি অন্য অসুখ আছে কি না তা পরীক্ষাও করতে দেওয়া হয়। রোগীর ওসিডি, ফোবিয়া বা কোনও নেশা আছে কি না, তা-ও দেখা জরুরি। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসার ধরনও বদলাবে। নেশা করার কেস হিস্ট্রি থাকলে আগে তা ছাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। যেমন, অ্যালকোহল ডিপ্রেশন বাড়িয়ে দেয়। তাই অ্যালকোহল আগে বন্ধ করতে বলা হয়। রোগী যদি নিজে থেকে তা বন্ধ করতে না পারেন, তখন তাকে সায়কায়াট্রিক সেন্টারে ভর্তি করতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে রিহ্যাবেও ভর্তি করতে হতে পারে।

চিকিৎসায় থেরাপি

‘‘কগনিটিভ বিহেভিয়োরাল থেরাপির মাধ্যমেই চিকিৎসা শুরু করা হয়। রোগীর চিন্তার ধরন, আবেগ ও ব্যবহারে ইতিবাচক দিক আনার চেষ্টা করা হয়। তার মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন দিয়েই শুরু করা হয়। ধরুন, কেউ ফুটবল খেলায় আগ্রহী, কারও আবার রং-তুলির প্রতি আকর্ষণ আছে, সেগুলোই শুরু করতে বলা হয়। পছন্দের বিষয়ের মধ্য দিয়েই তাঁর জীবনে ইতিবাচক দিক ফিরিয়ে আনা হয়।’’ অনেক সময়ে আপনজনের মৃত্যুতেও অনেকে অবসাদের শিকার হন। তখন সেই ডিপ্রেশন সাইকেল ভাঙতে তাঁকেও বিভিন্ন এনগেজিং অ্যাক্টিভিটির সঙ্গে যুক্ত করা হয়।

শরীরের অসুখ সারাতে যেমন চিকিৎসা করা জরুরি, তেমনই মনের অসুখের ক্ষেত্রেও তা দরকার। দীর্ঘস্থায়ী অবসাদকে অবহেলা করবেন না। চিকিৎসা করলে ডিপ্রেশন কাটিয়ে সন্ধান পাবেন নতুন জীবনের।